মুদ্রাদোষ

হাত নেই, পা নেই নাক নেই, কান নেই এরকম মানুষও হয়তো পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এ রকম মানুষ পাওয়া যাবে কি? মানুষ হলে তার ‘মুদ্রাদোষ’ থাকবেই। রাশি চক্রে বুধ, শুক্র, চন্দ্র এবং রাহুর দুর্বলতার কারণে মানুষের মধ্যে এমন মুদ্রাদোষ দেখা যায়।

আমার এক পরিচিত লোকের কাহিনি দিয়েই শুরু করি। ভদ্রলোক প্রতি বাক্যের শুরুতে কিংবা শেষে অথবা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে ‘আপনার’ ব্যবহার করবেই। ভদ্রলোক একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন: কালরাতে অনেক দেরি করে ‘আপনার’ বাসায় ফিরেছিলাম। গিয়ে দেখি ‘আপনার’ স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘আপনার’ এমন বেগতিক ঘুম যে আর জাগাতে সাহস পেলাম না। তারপর ‘আপনার’ আলোটা নিভেয়ে আপনার স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়লাম। খানিক পর ‘আপনার’ ঘরের মধ্যে একটা শব্দ হলো। ‘আপনার’ স্ত্রী চিৎকার দিয়ে আমাকে জাপটে ধরলো। এরপর আমি আলোটা জ্বালিয়ে দেখি ‘আপনার’ একটা বিড়াল। এরপর ‘আপনার’ স্ত্রী আর ঘুমুতে দেয়নি।

এবার চিন্তা করুন অবস্থাটা। ‘আপনার’ ঠ্যালায় কার বউ কার হেয়েছে! তবে প্রচলিত মুদ্রাদোষ গুলোর মধ্যে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ এর আধিক্য বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’-এর স্রোতে ভেসে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত বক্তা যে কী বলতে চান আর কিছুই বোঝা যায় না। এমনই একজন বক্তার উক্তি: মানে এই যে রাজনীতি, মানে সমস্ত ব্যাপারটা যদি ভেবে দেখা যায়, মানে তাহলে মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানে ব্যাপারটা মানে। অথবা এই যে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বুঝেছেন, সন্ত্রাস আসলে মানে বুঝেছেন, মানে ধরুন রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ব্যাপারটা হচ্ছে মানে ধরুন ব্যাপারটা বুঝেছেন কি না।
এইসব ধরণের জাতকের রাশিচক্রে বৃহস্পতি এবং বুধের ওপর কেতুর প্রভাবের ফলে কথার মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে অথবা পুনর্বাসু নক্ষত্রে অবস্থানগত গ্রহের কেতুর প্রভাবে জাতক একটা কথা বার বার বলতে থাকে।

সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালির মধ্যে দেখা যায়, সেটা হচ্ছে বাংলা কথাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমরা আংকেল অর্থাৎ মামা, মিডলইস্ট অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমার জন্য একটা গোল্ড চেইন অর্থাৎ সোনার হার পাঠিয়েছেন অথবা আমি মানে এক সময় খুব ভাল ছাত্র ছিলাম: আই ওয়াজ এ ভেরি ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এবসোলিউটলি মিনিংলেস। শুধু তাই নয়, এরা চান্স পেলেই ‘আমার ফাদার মানে বাবা’ কিংবা ‘আমার ওয়াইফ মানে স্ত্রী’-র (নারীদের সিংহভাগ জুড়ে ‘আমার হাজবেন্ড অর্থাৎ ও-র গুণগান শোনা যায়) গল্প শুনিয়ে ছাড়েন। এইসকল জাতকের কুস্টিতে বুধ আর বৃহস্পতি রাহুর দ্বারা পীড়িত হওয়ার ফলে এবং দ্বিতীয় ভাব বা পতি রাহু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জাতকের মধ্যে এই ধরণের প্রভাব পরে থাকে।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রসঙ্গ পেলেই বলে ওঠে, আমার ফাদার বুঝেছিস, এতো অনেস্ট ছিলেন যে সারা জীবন এক পয়সাও ঘুষ খাননি। আবার আরেক বউ-পাগল বন্ধু কথায়-কথায় ওয়াইফের প্রসঙ্গ টেনে আনে। হোটেলে ভাত খেতে বসেছি এ সময় তার বিবৃতি: আমার ওয়াইফ জানিস কিনা জানি না, এতো ফাস্ট-ক্লাস রান্না করে যে একবার খেলে জীবনে ভুলতে পারবি না। অথবা জানিস আমার ওয়াইফ না অদ্ভুত রিসাইট করে, ওর কন্ঠ এতো সুন্দর, একবার শুনলে পাগল হয়ে যেতে হয়। এখানে দেখা গেছে রোহিনী নক্ষত্র যখন কেতু দ্বারা পীড়িত হয় এবং তার সাথে বুধ বা শুক্র কোনো ভাবে পীড়িত হয় তখন জাতকের মধ্যে এমন ধরণের প্রভাব পরে।

আমাদের বেঁচে থাকার অনেক ঝামেলা আছে। বেঁচে থাকতে হলে এসব বক্তব্য হজম করতেই হবে। কারো বাবা মানে ফাদার, স্ত্রী মানে ওয়াইফ, যেমন হোক না কেন এতে যে আপনার আমার কিছুই যায় আসে না, কেউ তা জানবার জন্য উদগ্রীব নয়-এটা তাদের বোঝাবে কোন মূর্খ!

তবে সমস্ত মুদ্রাদোষকে ছাপিয়ে ওঠে শারীরিক মুদ্রাদোষ। এধরনের লোকেরা বসে বসে দোলেন, হাঁটু নাচান, হাত-পা নাড়েন নানা রকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুশী মারা, টেবিল চাপড়ানো-এসব ভয়ানক মর্মস্পর্শী উপসর্গ অনেকের দেখা যায়। আমার একজন ঘনিষ্ঠজন আছেন যিনি বেশি ফুর্তি হলে অথবা বেশ হাসি বা মজার কথা হলে ইহি ইহি করতে করতে নারী-পুরুষ নির্বশেষে পাশের ব্যক্তিকে সাপটে ধরেন এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে বিনা উস্কানিতে কিলঘুসি মেরে তা প্রকাশ করেন। পা বা হাটু নাচানোর ব্যাপারে অনেক অংশে দেখা যায় ভারণী নক্ষত্র কেতু দ্বারা এবং শুক্র কোনো ভাবে পীড়িত হলে এমন প্রভাব পড়ে জাতকের মধ্যে।

মুদ্রাদোষ নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমি যাহা অনুভব করেছি এ শিখেছি সেটা নিয়ে অল্প বিস্তর লিখলাম, এই গবেশনা চলছে আর চলবে, ভবিষতে যদি আরোও কিছু তথ্য পাওয়া যায় বা গুণী জনেদের থেকে তথ্য পাওয়া যায় তাহলে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো নিশ্চই।

প্রধানত দেখা গেছে বুধ, শুক্র, বৃহস্পতি আর রাহুর পীড়িত প্রভাবে মুদ্রাদোষ পাওয়া যায় কিন্তু বিভিন্ন নক্ষত্রের প্রভাবে এই মুদ্রাদোষ প্রকট আকার ধারণ করে। নক্ষত্র নিয়ে আমি অনেকদিন ধরেই কাজ করছি। নক্ষত্রের বিষয়টি মহা সাগরের মতন, আর আমি সমুদ্রের কাছেও পৌঁছাতে পারিনি।